রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৩ পূর্বাহ্ন
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গত ৮ জুলাই সংগঠনটির পরিচালনায় তৈরি করা হয় ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম। সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কলেজ এবং সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই সমন্বয়ক টিমে। তবে আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি থাকে তিনজনের কাছে, যারা গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামের একটি সংগঠনের শীর্ষ পদধারী। ওই তিন সমন্বয়ক হলেন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদার। তারা প্রত্যেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সূত্র বলছে, শুরু থেকেই ছাত্রশক্তি চেয়েছিল শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে সরকার পতনের দিকে নিতে। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনের পাশাপাশি শুরুতে আন্দোলনে রসদ জুগিয়েছেন ইনসাফ কায়েম কমিটি এবং এবি পার্টির নেতারা।
কোটা বাতিলের দাবিতে ২০১৮ সালের আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের হাত ধরে প্রথমে ছাত্র অধিকার পরিষদ, পরে গণঅধিকার পরিষদ নামে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। সেই ধারার অনুসারীই ছিলেন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও বাকের মজুমদার। নাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের, আসিফ মাহমুদ ভাষাবিজ্ঞান এবং আবু বাকের মজুমদার ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী।
জানা যায়, আসিফ গত বছরের ২৪ জুলাই ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন ও লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ তুলে ঢাবি শাখার সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তার সঙ্গে নাহিদসহ বাকিরাও ছাত্র অধিকার থেকে পদত্যাগ করেন। ওই সময় বাকের মজুমদার ছাত্র অধিকারের কর্মী থাকলেও তার কোনো পদ ছিল না।
পরে পদত্যাগকারী অংশটি ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনের নেতৃত্বে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ গড়ে তোলে। নাহিদ ইসলাম এই সংগঠনের সদস্য সচিব। আর আসিফ মাহমুদ সংগঠনটির ঢাবি শাখার আহ্বায়ক। অন্যদিকে, আরেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ঢাবি শাখার সদস্য সচিব নির্বাচিত হন।
২০১৮ সালের কোটার পরিপত্র বাতিলে হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের পর দ্বিতীয় দফা কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এতে ছাত্রশক্তির পাশাপাশি আরও কিছু শিক্ষার্থী যুক্ত হন, যারা সরাসরি ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্রশক্তি, ছাত্রদল, ফেডারেশন ও ইউনিয়নসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে শুরু হয় এই আন্দোলনের কার্যক্রম।
জানা গেছে, ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির’ সঙ্গে সম্পৃক্ত এই তিনজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারকে ব্যবহার করে তাদের নিজ দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর ছিলেন। সাধারণ ছাত্র এবং নিরপেক্ষ সমন্বয়করা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও তারা নেতৃত্বে থেকে আন্দোলনটিকে দীর্ঘায়িত করা এবং সরকার পতনের উদ্দেশ্যে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাদের প্ররোচনায়ই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সংঘর্ষটি এভাবেই শুরু হয়েছিল। তবে বেশিরভাগ সমন্বয়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার বিরোধী ছিলেন।
শুরুতে সমন্বয়কদের মধ্যে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ সজীব, আবু বাকের মজুমদার, হাসনাত আব্দুল্লাহ, মোহাম্মদ মাহিন সরকার, হাসিব আল ইসলাম, নুসরাত তাবাসসুম, আব্দুল কাদের, আবদুল হান্নান মাসুদ, হামজা বিন মাহবুবসহ আরও কয়েকজন অনেকটা মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও আন্দোলনটি সহিংসতায় রূপ নেয়। আর মূল সমন্বয়করা ধীরে ধীরে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সহিংসতা রোধে শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রস্তাব দিলে কিছু সমন্বয়ক সাড়া দিলেও নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার গা-ঢাকা দেন এবং অন্যদের একই কাজ করতে বলেন। এ সময় অন্য সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে তিন সমন্বয়ক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সমমনা ছাত্রদের মূল সমন্বয়কের ভূমিকায় রেখে কমিটি ঘোষণা করতে থাকেন। যাদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দিয়ে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, আন্দোলনের শুরুতে এই তিন সমন্বয়ক বিভিন্ন সময়ে বিএনপি, জামায়াত এবং অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। এ ছাড়া জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির নেতাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক হয় এসব নেতার। তাদের প্ররোচনায় টার্গেট হয়ে দাঁড়ায় সরকার পতন।
সূত্র বলছে, অ্যাক্টিভিস্ট শহিদুল আলমকে আন্দোলনের শুরুতে ১৪, ১৫ এবং ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া এই তিন দিন তাকে সমন্বয়কদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করতে দেখা গেছে। এর বাইরে শাহবাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় সব কর্মসূচিতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। যদিও ওই সময়ে তিনি ক্যামেরা হাতে ছবি তুলছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে।
সূত্রের দাবি, গণঅধিকার পরিষদ থেকে ভেঙে ছাত্রশক্তির প্রতিষ্ঠা হলেও সংগঠনটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির নেতাদের সঙ্গে। এবি পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, ছাত্রশক্তির সঙ্গে নীতিগতভাবে ঐক্যমতে পৌঁছেছিল এবি পার্টি। সংগঠনটি এবি পার্টির ছাত্র সংগঠন হিসেবে কাজ করার কথা ছিল।
জানা যায়, আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে এবি পার্টি শিক্ষার্থীদের জন্যে আইনি সহায়তায় আলাদা সেলও গঠন করে। দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের এই টিম গঠন করা হয়। এর বাইরে সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নির্দেশনায়ও পরিচালিত হন তারা।
আন্দোলনের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে সরকার কোটা সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এতে সরকার পতন এবং আন্দোলন দীর্ঘায়িত করার আর কোনো উপায় না দেখে তারা ৮ ও ৯ দফা দাবি পেশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শুরু থেকেই আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে দেশ এবং দেশের বাইরে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও আসিফ, বাকের ও নাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তবে বেশিরভাগ সমন্বয়ক এর বিরোধিতা করেছেন।
আন্দোলনের অন্যতম এক সমন্বয়ক কালবেলাকে বলেন, আমাদের আসলে এখন আর বের হওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিবাদ করলে সাধারণ মানুষ আমাদেরই ভুল বুঝবে। কিন্তু আন্দোলন ছিনতাই হয়ে গেছে। কয়েকজন মানুষের হাতে জিম্মি।
আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে একই তথ্য। তারা বলছেন, সরকার পতন আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না। সরকার দাবি মেনে নেওয়ার পরেই সমাপ্তি টানতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু উল্টো ঘটেছে এখন। আন্দোলন সমাপ্তির কোনো লক্ষণ দেখছি না।
নাহিদের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী জানান, সম্প্রতি শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী যে কোনো সমন্বয়ককে নাহিদ, আসিফ ও বাকের সমন্বয়ক গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বর্তমানে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বয়কদের সঙ্গে আসিফ এবং বাকের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করে যাচ্ছিলেন। অধিকাংশ সমন্বয়ক আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে কাজ করলেও ওই তিন সমন্বয়ক এবং তাদের মতাদর্শের আরও কয়েকজন পরিকল্পনা করছেন আন্দোলন দীর্ঘায়িত করার